গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আর্ন্তজাতিক দিবসে ফেনীতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে মানবাধিকার কর্মী ও গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা। ‘গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সহ সকল রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বন্ধ কর, গুমের শিকার ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দাও’ শ্লোগানে ৩০ আগস্ট সোমবার সকালে শহরের শহিদ শহিদুল্লা কায়সার সড়কে মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গুম হওয়া ব্যাক্তির স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাক ও হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারস নেটওয়ার্ক’র যৌথ আয়োজনে মানববন্ধন ও সমাবেশ প্রধান অতিথি ছিলেন দৈনিক ফেনীর সময়’র সম্পাদক ও ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’-সুজন ফেনী জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন। দিবসের মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মায়ের ডাক ও হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারস নেটওয়ার্ক’র কো-অর্ডিনেটর, অধিকার ফেনীর ফোকাল পার্সন ও দৈনিক মানবজমিন’র জেলা প্রতিনিধি নাজমুল হক শামীম।
মানবাধিকার কর্মী তন্বী সোম’র সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ইয়ুথ জার্নালিষ্ট ফোরাম ফেনী শাখারর সভাপতি ও দৈনিক অজেয় বাংলার নির্বাহী সম্পাদক শাহজালাল ভূঞা, ফেনী গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ আলী নসু, ফেনী লিও ক্লাবের প্রেসিডেন্ট মুরাদ হাসনাত রাফি, গুমের শিকার হওয়া যুবদল নেতা মাবুবুর রহমান রিপনের মা রৌশন আরা বেগম, বড় ভাই মাহফুজুর রহমান, মেঝ ভাই মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।
এ সময় গুমের শিকার রিপনের চাচা ওহিদুর রহমান, রিপনের বড় মেয়ে ফারিয়া আক্তার নিশাত, ছোট মেয়ে ফাহিমা আক্তার নাওফি, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও মানবাধিকার কর্মী কাজি ইকবাল আহমেদ পরান, বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট এসোসিয়েশন ফেনী জেলা শাখার সভাপতি ও মানবাধিকার কর্মী মোস্তফা কামাল বুলবুল, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী এমডি মোশাররফ, ইংরেজী শিক্ষক ও মানবাধিকার কর্মী আবদুস সালাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মানববন্ধনে মানবাধিকার কর্মী ও ভিকটিম পরিবারগুলোর স্বজনরা গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণ করে তাঁদেরকে তাঁদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে দেশের সকল নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। সরকার আন্তরিক হলে দেশে গুম বন্ধ হবে এবং সকল নাগরিক নিরাপদে বসবাস করবে।’
সমাবেশ থেকে গুমের পাশাপাশি ‘এনকাউন্টার’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ নামে দেশের নাগরিকদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা ও হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যাসহ সমস্ত ধরণের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে। বক্তারা বলেন, ‘গুম একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ, যা মৌলিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবেও স্বীকৃত। গুম রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের একটি বড় হাতিয়ার। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার অজুহাতে গুম জনিত অপরাধ মূলতঃ তাঁদের বিরুদ্ধেই প্রয়োগ করা হয় যাঁদেরকে সরকার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে।’
ফেনীতে বিগত এক যুগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিভিন্ন সময়ে গুমের শিকার হয়েছেন ফেনী শহর যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান রিপন, সদর উপজেলার লেমুয়া ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা মো. ইউসুফ, সোনাগাজীর চরচান্দিয়ার যুবলীগ নেতা সরওয়ার জাহান বাবুল, একই এলাকার যুবগলীগ নেতা গাজি মিলন। যাদের আজও সন্ধান কিংবা ফিরে পায়নি স্বজনরা।
এদিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচও তার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বলপূর্বক গুমের শিকার ৮৬ ব্যক্তি এখনো নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানিয়ে এই ঘটনাগুলোর আন্তর্জাতিক তদন্ত করতে বলেছে। যদিও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর প্রতিবেদনে প্রকাশিত সংখ্যার থেকে প্রকৃত পক্ষে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের সংখ্যা আরো অনেক বেশী।
অপরদিকে অধিকার এর সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ১ লা জানুয়ারী থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৬০৩ জন গুমের শিকার হয়েছেন। অধিকার জানায়, অধিকার তখনই গুমের ঘটনা লিপিবদ্ধ করে, যখন গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবার এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা এই বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করেন যে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য পরিচয় দিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর ‘গুম হওয়া থেকে সমস্ত ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদ’টি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। গুম হওয়া থেকে সমস্ত ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশন-এমন একটি চুক্তি যা অনুস্বাক্ষর করার ক্ষেত্রে প্রতিটি রাষ্ট্রের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে।