জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান-এর আন্তরিক চেষ্টায় আজ আমরা বাংলাদেশে কাজী নজরুল ইসলামকে পেলাম। তিনি আজ আমাদের জাতীয় কবি। কিন্তু আমাদের অনেকের কাছে হয়তো নজরুল বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে আসার নেপথ্যের ইতিহাস জানা নেই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে কবির জন্মজয়ন্তী পালনের ইচ্ছা পোষণ করেন। কবির জন্মদিন পালনের পর আবার কবিকে ফেরত পাঠাবেন মর্মে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুমোতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে স্বপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। ধানমন্ডি ১৮ নম্বর সড়কে ‘কবি ভবন’ নামে একটি ভবনে কবিকে রাখার জন্য নির্ধারণ করা হয়। সেখানে কবিকে রাখা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। যা বর্তমানে ‘কবি ভবন’ নামে পরিচিত। কিন্তু অসুস্থতার কারণে কিংবা কবির প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার কারণে কবিকে আর ভারতে পাঠানো সম্ভব হয়নি। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর কারণে আজ কবি বাংলাদেশের নাগরিক এবং জাতীয় কবি হন। মৃত্যুর আগে কবিকে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়।
১৯৭২ সালের ২৪ মে অসুস্থ কবি ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন। কবির সঙ্গে ছিল বড় ছেলে কাজী সব্যসাচী (বিশিষ্ট আবৃত্তিকার) ও তাঁর স্ত্রী উমা কাজী, ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধ ও তাঁর স্ত্রী কল্যাণী কাজী এবং তাঁদের সন্তানেরা। এরা ছাড়াও সঙ্গে এসেছিলেন কবির ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডি কে রায়ও। সেদিন বেলা সাড়ে ১১টায় তৎকালীন তেজগাঁও বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের একটি বিমানে ঢাকায় অবতরণ করেন। সেদিন হাজার হাজার মানুষ প্রিয় কবিকে স্বাগত জানায় বাংলাদেশে।
নজরুল যদি বাংলাদেশে না আসতেন তাহলে হয়তো তার ইচ্ছানুযায়ী মসজিদের পার্শ্বে কবর হতো না। কারণ নজরুলের চিন্তা চেতনা দর্শন এবং ধর্ম বিচারে অনেকে তাকে হয়তো কবর দিতে চাইতো না। যাক সবই আল্লাহ পাকের ইচ্ছা। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক তার উপর রাজি খুশি হয়েছেন। তা নাহলে তিনি কেনো বাংলাদেশে আসবেন আবার ১৯৭৬ সালে মৃত্যু পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় মসজিদের পার্শ্বে কবর পাবেন, এটা সাধারণ বিষয় নয়। একথা সত্য কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পার্শ্বে কবর দেয়ার জন্য সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে। জিয়াউর রহমানের জোরালো ভূমিকা না রাখলে তা কিছুতেই সম্ভব হতো না। কারণ অনেকে কবির মাজার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে দেওয়ার বিরোধীতাও করেছিলেন। জিয়াউর রহমান তাদের ষড়যন্ত্র সম্পূর্ণ বাতিল করে দেন। জিয়া নিজ হাতে কবির লাশ নিয়ে করবে রাখেন। এমন সম্মানজনক সৌভাগ্য প্রমাণ করে আল্লাহ পাক কবির প্রতি অবশ্যই রাজি খুশি হয়েছেন।
নজরুলের আদি জন্মস্থান বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম জন্ম গ্রহণ করেন। কিশোর নজরুল বর্ধমানের আসানসোলের একটি রুটির দোকানে কাজ কাজ করতেন। সেখান থেকে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহের ত্রিশালের কাজীর সিমলা গ্রামের দারোগা কাজী রফিজউল্লাহ প্রথমবার কবি নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। এরপর তিনি বড় হন, কবি খ্যাতি অর্জন করেন সেই ইতিহাস আরেক রকম। বাংলা সাহিত্যে তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে পরিচিত নজরুল। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি আমাদের রণসংগীতেরও স্রষ্টা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০ জন কবি সাহিত্যিক ‘ডক্টর অব লিটারেচার’ ডিগ্রী লাভ করেন। তাদের মধ্যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪সালে ‘ডক্টর অব লিটারেচার’ ডিগ্রী লাভ করেন। ১০ জন ‘ডক্টর অব লিটারেচার’ ডিগ্রিপ্রাপ্তরা হলেনÑ মহামহোপাধ্যায় পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৯২৭), ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ সরকার (১৯৩৬), কবি ও দার্শনিক স্যার মোহাম্মদ ইকবাল (১৯৩৬), বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৩৬), শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৬), বহু ভাষাবিদ ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (মরণোত্তর-১৯৭৪), জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৯৭৪), ওস্তাদ আলী আকবর খান (১৯৭৪), অধ্যাপক আবুল ফজল (১৯৭৪) ও অধ্যাপক রণজিত গুহ (২০০৯)।
আজ ১১ই জ্যৈষ্ট ২৫শে মে’২০ সাল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২১ তম জন্মজয়ন্তী। অপরদিকে আজ পবিত্র “ঈদ উল ফিতর” এর দিনও। করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে এক ভিন্ন মাত্রায় আজ জাতীয় কবির জন্ম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। একদিকে ঈদেও আনন্দ অন্যদিকে নজরুলের জন্মদিনের আনন্দ যোগ হয়েছে।
আজ আমরা ‘ওমন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’যে গানটি গেয়ে ঈদ উদযাপন করছি তার রচয়িতা কাজী নজরুল ইসলাম। দেশে এমন কোনো নারী-পুরুষ নেই যারা এ গাননি শুনেনি কিংবা নিজে গুনগুন করে গায়নি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত এই গানটি ‘ঈদ উল ফিতর’ বা রমজানের ঈদে “ঈদের গান” হিসেবে গাওয়া হয়। গানটি এতোটাই জনপ্রিয় যে গত প্রায় ৯১বছর যাবত প্রচার হয়ে আসছে কিন্তু জনপ্রিয়তায় এতোটুকুও ভাটা পড়েনি। কত প্রজন্ম পার হলো তবুও গানটি সব প্রজন্মের কাছে সমান জনপ্রিয়। এমনকি জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে যায় যে, গত এক দশক আগে অনেকে গানটি তাদের মোবাইলের রিং টোন হিসেবেও ব্যবহার করে।
জাতীয় কবিকে বাংলাদেশে আনার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ অবদান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে কবর দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদান আমরা কোনো দিন ভুলবো না।
লেখকঃ কলামিস্ট ও সাংস্কৃতিক কর্মী।
arzufeni86@gmail.com